১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পিরোজপুরে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন তদানীন্তন ছাত্রনেতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর ফারুক। স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস গ্রুপের এই ছাত্রনেতা ছিলেন পিরোজপুরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। আর এই অভিযোগেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর একটি রডের এক মাথায় সেই পতাকা বেঁধে আরেক মাথা হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় তার মাথায়। এমন নির্মমভাবে হত্যার পরেও দমেনি পাকিস্তানি হানাদাররা। অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা দিতে তার দেহ ৩ দিন গাছের সঙ্গে লটকে রাখা হয়।
ওমর ফারুকের জন্ম ১৯৫০ সালের ১২ মার্চ কাউখালী উপজেলার আমড়াজুড়ি গ্রামে। তার বাবার নাম মরহুম সৈয়দুর রহমান শরীফ। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলনের সময় ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন ওমর ফারুক। পাকিস্তানিদের হাত থেকে দেশ রক্ষার তাগিদ অনুভব করে কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতাদের সঙ্গে যোগ দেন ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ গ্রুপে। গড়ে তোলেন পিরোজপুর মহকুমা ছাত্রলীগ।
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর সংগঠকের দায়িত্ব নিয়ে জড়ো করতে থাকেন মুক্তিযোদ্ধাদের। পাকিস্তানি ট্রেজারি ভেঙে অস্ত্র সংগ্রহও করেছিলেন। প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ভারত যাওয়ার। তবে ২৯ মে স্বাধীন বাংলার পতাকাসহ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান তিনি। টর্চার সেলে চলে চরম নির্যাতন। কিন্তু ভেঙে পড়েননি ওমর ফারুক। এক সময় তার মনোবল ভেঙে দিতে তাকে বলা হয়েছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দিলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু তিনি সে শ্লোগান না দিয়ে দিয়েছেন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে রাজাকাররা লোহার রডের সঙ্গে স্বাধীন বাংলার পতাকা বেঁধে তা হাতুড়ি পেটা করে ওমর ফারুকের মাথায় ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর বরিশালের টর্চার সেলে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের ‘শিক্ষা’ দিতে ৩ দিন গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয় শহীদ ওমর ফারুকের লাশ।
পিরোজপুর শহরের তৎকালীন টাউন হল (বর্তমানে টাউন ক্লাব) মাঠে শহীদ মিনারের সামনে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ওমর ফারুক প্রথম উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলার পতাকা। এরপর তিনি ছাত্রদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকেন।
ওমর ফারুক তখন বি.কম শ্রেণির ছাত্র এবং একই সঙ্গে মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজের ভিপি ছিলেন ।
‘১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল ওমর ফারুক স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানা ও ঝালকাঠির কীর্তিপাশায় গেরিলা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রহে যান। এদিকে ২ মে পিরোজপুর ট্রেজারির কোষাগার লুট হয়। ৩ মে বরিশাল থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এসে পিরোজপুর দখল করে নেয়। ট্রেজারি থেকে অস্ত্র নেওয়ার দায়ে ওমর ফারুকসহ তার সহযোগীদের নামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হয়। এ মামলায় তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হলে পিরোজপুরে প্রকাশ্যে চলার পথ বন্ধ হয়ে যায়। পিরোজপুরে না আসতে পেরে স্বরূপকাঠির আটঘর-কুড়িয়ানার সাবেক প্রেসিডেন্ট নানা মৌজে আলী মিয়ার বাড়িতে আশ্রয় নেন ভারত যাওয়ার জন্য। ২৫ মে আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য বরিশাল যান। সেখানে ঠিকানা পেয়ে মাটিভাঙা হয়ে ভারতের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করেন ওমর ফারুক। ২৯ মে ১৯৭১ সকাল ৬ টায় বাউলাকান্দা ফেরার পথে এক সময়ে পিরোজপুরে কর্মরত পুলিশ সদস্য হানিফ তাকে চিনে ফেলেন এবং আলবদরদের সহায়তায় আটক করে প্রথমে তাকে বরিশাল কোতোয়ালী থানায় নিয়ে যায়। পরদিন (৩০মে ১৯৭১) তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় বরিশাল ৩০ গোডাউনের টর্চার সেলে।
‘ওই নির্যাতন কক্ষে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হক স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে জানান, ১৯৭১ সালের ৪ জুন হানাদার বাহিনী ওমর ফারুকের সঙ্গে থাকা ব্যাগ খুলে তল্লাশি চালিয়ে খুঁজে পায় ৭টি স্বাধীন বাংলার পতাকা। এ কারণে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশে রাজাকাররা লোহার রডের সঙ্গে স্বাধীন বাংলার পতাকা বেঁধে তা ওমর ফারুকের মাথার মধ্যে হাতুড়ি পেটা করে ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর বরিশালের টর্চার সেলে আটক থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের শিক্ষা দিতে ৩ দিন গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে শহীদ ওমর ফারুকের লাশ।’
:-তথ্য সংগ্রহিত