খা খা লক্ষিন্দর রে খা! সর্প!!

0
830

খা খা লক্ষিন্দর রে খা! সর্প!!

অলোক কুমার মিস্ত্রী
(বন্যপ্রাণী গবেষক)

গ্রীকপুরাণ, ধর্ম, মিথ, কৃষ্টি-সভ্যতা, কু-সংস্কার, জুয়োলজি যেখানেই যাই না কেন, রেপটাইলস শ্রেণির এই সর্প নিয়েই সব থেকে বেশি মাতামাতি, ব্যাপারটা নিছক নাচানাচি, সেই বেদে সম্প্রদায়, কামরুক ক্যামাক্ষা থেকে আজ অবধি কম তো হোল না ! লতানো,প্যাঁচানো, গা ঘিনঘিন করা অনুভূতি নিয়ে আসা এই প্রানীটাও ব্রিডিং এর মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম দেয় ডিম থেকে। আবার ব্যতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়, ক্ষেত্র বিশেষে বেশ কিছু সাপ সরাসরি বাচ্চা দেয়। আবার কিছু ডিম পেটের ভেতরেই রেখে দেয়। বাচ্চা জন্মানোর সময়ে ডিম দুনিয়ার আলো বাতাস এর স্পর্শ পায়। জগতে সাপের প্রজাতি সংখ্যাটা প্রায় ২৯০০ এর কাছাকাছি । আমাদের সাপুড়ে বেদে সম্প্রদায়দের হিসেবে মনে হয় কয়েক লাখ হবে হয়তো বা। তবে এর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি খুবই দূর্বল। শৈশবে যখন সাপুড়েরা সাপ নিয়ে গ্রামগঞ্জে ঘুড়ে বেড়াত, ঠিক সেই সময় থেকে এই সর্প খেলা দেখতে দেখতে পিরোজপুর জেলা ইস্কুলের পিছনে পুরাতন কোটকাচারীর সামনে ইস্কুলের ছুটির ঘন্টা বাজতেই ছুটে যেতাম সর্প নাচ দেখতে, সেই থেকে দুর্বলতা নেমে আসে, আজো ওয়াইল্ড লাইফ নিয়ে বুদ হয়ে আছি সর্পঘোরে। সে সময় ১ টাকা দিয়ে সাপুড়ের হরেক রকম সর্প নাচন দেখতাম, তখন এ প্রাণীটির বৈজ্ঞানিক নামধাম, এর জাত পাত নিয়ে ততটা ভাবিনি। হাতে নিয়ে ধরে দেখেছি, ভাবিনি এতটা বিষের থলি গলেতে। আমি হা করে সাপুড়েদের ইচ্ছেমতন বানানো গল্পকথা শুনতাম। সাপের মাথার মণি, কেমন করে বিষ দাঁত ভেঙ্গে ফেলা হলো? কিংবা একটা আস্তো ইঁদুর, সাপ মুখে দিয়ে ঢুকিয়ে, ফস করে টান দিয়ে পেটে নিয়ে যেতো! আর যা হোক, আমি বেদে নই, তাই আবার ডিমের ইতিহাসে ফিরে যাই। আমার জানা মতে গোখরা সাপ ছাড়া আর কোন সাপেরই স্থায়ী লাভার থাকে না। এরা আজীবন প্লে বয় কিংবা প্লে গার্ল! তবে সর্প জগতেও ফিমেলরাই তাদের ইচ্ছা শক্তির অধীশ্বর। আমাদের বাংলাসিনেমা বেদের মেয়ে জোছনায় যেমন দেখানো হয়েছে নাগ নাগিনীর লাগি, সর্বশক্তি বিসর্জন দিয়ে ইয়ে টিয়ে পার হয়ে, মানে সাত সমুদ্র পার হয়ে, ভিলেনকে মেরে তার নাগরাজকে নিয়ে যায়, বাস্তবে আসলে এর ভিত্তি আদৌ নেই। ও ছুরি, হবে নাকি বলে? বেটা সাপ প্রপোজ করে, মন মর্জি ভালো থাকলে, ছুরি বলে, আয় কাছে আয়! আর না হলে, বলে আর জ্বালাতন করিস না, বেটা সর্পরা আদর সোহাগ করতে গেলেই মারামারি শুরু করে দেয়। যে জিতে সেই শায়েনশাহ এর মতন এগিয়ে যায়। এই মারামারির সময়ে ছুরি সর্পঅঙ্গে রোদ লাগিয়ে বেড়ায়, কে মরলো, কে বাঁচলো, তাতে তার কিচ্ছুটি আসে যায় না! এই লড়াইয়ে জিতে যে কাছে আসবে সেই পেয়ার পাবে। তা পেয়ার জগতে গিয়ে আমরা দেখি, বেটা সাপের ব্রিডিং অর্গান আবার দুটো এবং পুরোপুরি এক্টিভ। আর ছুরি সর্প হলো রহস্যের ঘাঁটি। এরা ডিসাইড করে কোন সর্পকে তার সন্তানের বাপ বানাবে। যার ফলে অনেকের সাথে ডেটিং করলেও সিদ্ধান্ত হবে যেকোন একজনের স্পার্ম ব্যবহার করে ডিম ব্রুড করতে। কিভাবে কি করে, তা অনেকটা ধোঁয়াশা। তা সর্পণী এখানেই থেমে নেই, একবার ভেতরে শুক্রাণু নিলে, সে ৫ বছর অবধি নিজের পেটে থলি বানিয়ে তা আবার ধারণ করে রাখতে সক্ষম । আবার ইচ্ছে হলে ব্যবহারও করতে পারে। ঐশ্বরিক শক্তি বলে মনে হয়, এ কারণে অনেক বেটা ছেলে সাপ মরার পরে বাপ হবার স্বাধ পূরণ করে বই কী!
‘মিলন হবে কত দিনে?
মনের সর্পরেও সনে’-এ গান গাইতে গাইতে, কুমারী ছুরি সর্পণী যখন মা হবার মতো কলঙ্কিনী হয়ে গেল, তখন আবার নতুন জীবন শুরু। স্যাঁতস্যাঁতে জায়গা কিংবা উঁচু ঢিবির মতো জায়গা, কখনও গাছের খোলস, আবার কখনও নিজের শরীরকে প্যাঁচ মেরে মেরে এরা নিজের ডিমের জন্য বাসা বানাতে সদা তৎপর। প্রজাতিভেদে সাপ ৫০ টা অবদি ডিম দিয়ে থাকে আবার। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় গড়ে দু’মাস সময় লাগে। আবার এনাকোন্ডার ক্ষেত্রে এটা ৬/৭ মাস অবদি লাগে। ২৮-৩০ ডিগ্রী তাপমাত্রাই ডিম ফোটে বের হবার জন্য সবচেয়ে কার্যকর তাপমাত্রা বলে বিবেচিত। এনাকোন্ডা সাপ এই ক্ষেত্রে বেশরম, এই দীর্ঘ সময় ধরে গর্ভবতী হয়ে বসে থাকতে হবে বলে, মিলনের পরে অনেক সময় বেটাছেলে সাপটাকে আস্তো খেয়ে ফেলে। এ দীর্ঘ সময় শরীরের আমিষ প্রোটিন ওখান থেকেই আসে। আবার সাপের মায়ের পুত্র শোকের কারণে, অনেক সময় এনাকোন্ডা বাচ্চা জন্ম দেয়ার পরে বাচ্চাকেও খেয়ে ফেলে, পেটের ক্ষুধার যন্ত্রনায়। সচরাচর এক ডিম থেকে এক বাচ্চা বের হবার কথা থাকলেও অনেক সময় এক ডিম থেকে ৫/৬ টা অবধি বাচ্চা বের হয়ে আসে। এদের জমজ বলা যাবে কিনা অথবা এদের আচরণ এক রকম হয় কিনা তা নিয়ে মত পার্থক্য আছে সর্পবিজ্ঞানী মহলে। কেমোথেরাপিতে সর্প বিষ ব্যবহারসহ বিভিন্ন কাজে সাপ লাগে। তাই দেশে বিদেশে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন জাতের লাভজনক সাপের খামার। ডিম পয়দা হয় সেখান থেকেই। সাপের মাংস কোলেস্টেরল ফ্রি দেখে চীনদেশে জনপ্রিয়। ইন্দোনেশিয়ায় সাপের বার্গার, ভিয়েতনামে সরাসরি কাঁচা হৃদপিন্ড বের করে ভাতের সাথে পরিবেশন করা হয়। এমনি কিছু সে দেশে কিছু জায়গায় ওয়াইন গ্লাসে তাজা রক্ত দেওয়া হয় কয়েক ফোঁটা। তাইওয়ানে অনিষিক্ত বাচ্চা খাওয়া হয়। অর্থাৎ বাচ্চা ডিম ফুটে বের হওয়ার আগেই খেয়ে ফেলা। দক্ষিন কোরিয়ায় সিউল অলিম্পিক অংশগ্রহণ করার জন্য এমন প্রতিযোগী ছিল, যে প্রতিদিন একাই ২০০ সাপ খেত।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here