অনুগল্প “ভেলকি”

0
1312

ভেলকি

আশিক মাহমুদ রিয়াদ

১.লঞ্চঘাটে বসে বিরস মুখে বিড়ি টানছে হাজের মিয়া। নদীতে জোয়ার এসেছে,নদীর পানি পল্টুনে ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে করে পল্টুনের সাথে বাড়ি খাচ্ছে। আকাশে মেঘ রোদের খেলা চলছে সকাল থেকে। বৈশাখ মাস বইতে শুরু করেছে গত ছ’দিন আগে। ঝড়বৃষ্টির খবর নেই। দম মেরে আছে আকাশটা। কখনো রোদ আবার কখনো ছায়া।

হাজের মিয়া লঞ্চঘাটে কুলির কাজ করে,মাঝেমধ্যে নদীতে মাছ ধরে। এছাড়াও টুকিটাকি কাজ করে সে। আজকাল কোন কাজ নেই, মানু্ষ নেই হাটবাজারে। ছোটবেলায় সে দাদীর মুখে শুনেছে, ‘উলা বিবি আইছিলো নাকি এই গ্যারামে। তহন নাকি এহনকার ঈমাম সাহেবের দাদার বাপে উলা বিবিরে দেখছিলো। সন্ধ্যাবেলা মাগরিবের নামাজ পড়াইয়া গায়ের পথ দিয়া বাড়িতে ফিরছিলো সে। হঠাৎ কইরা তার সামনে পড়ে উলাবিবি। তিনি ডরান নাই, মুখে আল্লাহ-খোদার নাম নিয়া সোজা হাটা দিছেন। তার দিন তিনেক পরে সে অসুস্থ হইলো। সপ্তাহের মাথায় মারা গেলো। এরপর ধীরে ধীরে গেরামের মানু্ষ আক্রান্ত হইয়া মরতে লাগলো।

হাজের মিয়া মুখে বিড়িটা নদীতে ফেলে দেয়। ছ্যাৎ করে শব্দ হয়।বাতাসের শব্দে তা অস্পষ্ট শোনায়। কিন্তু শব্দটা হাজের মিয়ার কানে আসে। হঠাৎ আনমনা হয়ে পড়ে সে। বিড়বিড় করে বলে,’এমন একখানা রোগ বাইর হইছে, যেই রোগের চিকিৎসাও বাইর হয় নাই। হাট-ঘাটে মানু্ষজন নাই। আল্লাহ রহম করো!”

হাজের মিয়া গামছা দিয়ে মুখ মুছে জেটি থেকে উঠে সরু পথটা দিয়ে হাটতে থাকে।বিড়বিড় করে বলে,’এই রোদ্দুরে! এই সময়ে বাইর হওয়া উচিত হয় নাই। মাথা ঘোরে। বড্ড পেরেশানি লাগে! ‘

২.ঘরের চৌকাঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে জামিলা বেগম। সকাল থেকে খাওয়া হয়নি তার। ঘরে দু মুঠো চিড়া ছিলো সেটা স্বামী আর দুই সন্তানকে ভাগ করে দিয়ে তার কপালে জোটেনি কিছু। ক্ষুধা লেগেছে। ঘরে চাল নেই,ডাল নেই। কি খাবে!  গৃহস্থের মানুষটারও খোঁজ নাই । পাশের বাড়ির শিউলির কাছে থেকে শুনেছে চেয়ারম্যান নাকি ত্রান দিচ্ছে। মানুষটারে পাঠাইয়া দিলেও তো আনতে পারতো কিছু। কামাই নাই, রোজগার নাই। পেটে দুইডা দানা না পড়লে শরীর বাঁচব কেমনে?’

দশ বছরের শেফালি বারান্দায় বসে পুতুল খেলতে খেলতে মাকে বলে,’মা খাওন দেও। ক্ষিধায় পেট কামড়ায়। ‘ জামিলা বেগম মেয়েকে ধমকের সুরে বলে,’চুপ কর ছেমড়ি! খাওন পামু কোথায় তার নাম নাই। খাওন না থাকলে দিমু কি? হাঙ্গা দিন খালি খাই খাই। তোর বড়ডায় গেছে কই? হাঙ্গাদিন টক্করটক্কর কইরা ঘুইরা বেড়াইবো। আউক আইজক্যা। পিঠের উপর যদি না দিছি দুই ঘা, আমার নাম জামিলা না।’

লম্বা লাইন। গাদাগাদি, ঠাসাঠাসি। চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিনের বাড়িতে ত্রান দেওয়া হচ্ছে। গায়ের অর্ধেক মানুষের বিচারণ এখানে। দু একটা দোকান পাটও বসেছে। বিশৃঙখলার কারনে আপাতত ত্রান দেওয়া বন্ধ৷ কেউ কেউ বিড়বিড় করে চেয়ারম্যানকে গালি দিচ্ছে।

ঠ্যালাঠ্যালি আর গাদাগাদির মধ্যে চাপ সহ্য করে কোন রকম টিকে আছে নুরু মিয়া। সে এসেছে ত্রান নিতে। একেকটা শরীর লেপ্টে আছে একে অপরের সাথে।

 চেয়ারম্যান এলেন। এখন চলছে ফটোসেশন। ত্রান বিতরন কার্যক্রম আবারো শুরু হয়েছে। বেলা গড়িয়ে সুর্য ঢলে পড়েছে। চেয়ারম্যান সাহেব গলা উঁচিয়ে বললেন, ‘আজকে আর ত্রান দেওয়া হবে না ভাইসাব। আপনারা যারা ত্রান পাননি তারা কালকে আসেন। সবাইকে ত্রান দেওয়া হবে। ‘

৩.সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়ে ত্রান পায়নি নুরু মিয়া৷ এদিকে পেটে দারুন ক্ষুধা, মাথায় ঘুরছে তার। শরীর ক্লান্ত লাগছে৷ বিরসমুখে সে বাড়ির পথে এগোলো।

পথিমধ্যে দেখা হলো নুরুর স্কুলের বন্ধু মফিজের সাথে৷ মফিজ নুরুকে দেখে বলে,’কী রে নুরু ত্রান পাও নাই?’ নুরু ভুরু কুচকে জবাব দেয়,’না রে, চেয়ারম্যান সাব ত্রান দিলো না।’ মফিজ বলে, ‘আমি পাইছি,আব্বায় আবার গেছে ত্রান আনতে৷ আমি বাড়িত যাইতেছি ত্রান নিয়া। ‘ নুরু বিরস মুখে বলল,’যা! তোগোই তো কপাল। ‘ কিছুদূর যেতে নুরু ফিরে এলো মফিজের কাছে। ‘তোর আব্বায় না ত্রান আনতে গেছিলো? ‘ মফিজ ভুরু কুচকে বলল,’হ গেছিলো তো, ক্যান কি হইছে?’ নুরু বলল,’তোর আব্বারে চেয়ারম্যান সাবে বাইন্দ্যা রাখছে৷ দেখ গিয়া। মফিজ হতভম্ব হয়ে গেলো।, ‘তুই সত্যি কইতাছোস নুরু, তুই নিজের চোখে দেখসোস? আল্লাহ রে এহন কি হইব। তুই মিথ্যা কইতাছোস না তো? সত্যি কইরা ক৷

নদীর পাড় ঘেষা রাস্তা দিয়ে হাটছে নুরু । তার কাধে ত্রানের বস্তা৷ মফিজকে সে তার ভেলকিবাজি দেখিয়ে বোকা বানিয়ে ফেলেছে । মফিজ নুরুদের বাড়ি চেনে না। আর চিনলেও বা কি? খুঁজে পেতে পেতে সময় লেগে যাবে। ততক্ষনে রান্না হয়ে যাবে। দুটো দানা মুখে দিতে পারবে৷

হাজের মিয়া ফিরেছে, তার কাঁধের গামছা দিয়ে সে মুখের ঘাম মুছছে। অতিষ্ট করা রৌদ্র উঠছে। শেফালি এসে তার বাবার কাছে বলল,’বাপজান? আমার অনেক ক্ষুধা লাগছে। তুমি কি বাজারে গিয়া চাউল আনতে পারো? মায় কইছে ঘরে চাউল নাই।

হাজের মিয়া বলল,’ঘরে চিড়া আছে না? চিড়া খা। চাউল আনমু কেম্নে? টাকা পয়সা হাতে নাই রে মা। এর মধ্যে ঘরের ভেতর থেকে হাজির হয় জামিলা। সে মুখে ভেঙচি কেটে বলে,’চিড়া কই দিয়া পাইলা তুমি?  চিড়া কি উইড়া উইড়া আইবো?’ হাজের মিয়ার মাথা গরম হয়েছে। মাঝেমধ্যে সে এই মহিলাকে সহ্য করতে পারে না। হাজের মিয়া মুখে গালি দিয়ে জামিলার দিকে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে৷ জামিলা বেগম সরে যায়।

শেফালি কাঁদছে! নুরু বলল,’কান্দোস ক্যান? কানলে তোরে পেতনির লাহান লাগে। মায় কই? আব্বায় কই?’ শেফালি চোখ মুছতে মুছতে বলে,’মায়রে আব্বায় মারছে!’ জামিলা বেগম কাঁদতে কাঁদতে হাজির হয় এর মধ্যে। তার হাতে বাশের চিকন কঞ্চি। দে ঝপাং ঝপাং করে নুরুকে বাড়ি দিতে থাকে, ‘হারামজাদা বজ্জাত! সকাল থেইকা কই গেসিলি? তগোর লইগা আমার জীবনডা শেষ হইয়া গেলো।

নুরু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে, গড়াগড়ি করে কাঁদে। কিছুক্ষন পরে জামিলার চোখ যায় ত্রানের বস্তার দিকে। সে এগিয়ে দেখে এটা ত্রানের বস্তা।শেফালিকে বলে,’এইডা কেডা আনছে?’ শেফালি কাঁদতে কাঁদতে বলে,’ভাইজান আনছে। ‘ জামিলা নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছুটে গিয়ে নুরুকে জড়িয়ে ধরে৷

মফিজের কান লাল।সে কাঁদছে। মফিজের বাবার দাতমুখ শক্ত করে বলছে,’তোর কাছ দিয়া বস্তা নিয়া গেলো। আর তুই কিনা ভ্যাবলার মতো বস্তা দিয়া আইলি? বজ্জাত পোলা তোর মতো পোলারে লাগে গাঙ্গের জোয়ারে ভাসাইয়া দেওয়া। কই ঐ হারামজাদার বাড়ি কই? আইজক্যা ওর একদিন ওর চৌদ্দ গোষ্ঠির একদিন তো আমার একদিন৷ মফিজ আর মফিজের বাবা প্রায় নুরুদের বাড়ির কাছে চলে এসেছে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here