বউ আইসকিরিম খাও
আরিফুজ্জামান
দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলেন আনুমানিক সত্তর ছুঁই ছুঁই এক দম্পত্তি,,, ডাক্তার সানজিদা আড়চোখে দম্পতির দিকে একবার তাকিয়ে ইশারায় তার সামনের চেয়ারে বসার ইংগিত দিলেন।। . প্রেসক্রিপশন লিখতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, -রোগীর নাম? বৃদ্ধ লোকটি লাজুক হেসে উত্তর দিলেন, -আমার বউ।। বৃদ্ধের সলাজ হাসি দেখে ডাক্তার সানজিদার চোখ কপালে উঠল।। . -বউতো বুঝলাম, নাম বলেন।। -আমার নাম হোসনা।। রোগী আমার বউ।। -আরে চাচা বুঝলামতো! আপনার নাম হোসনা, রোগী আপনার বউ, রোগীর নামটা বলেন।। . ডাক্তার সানজিদা একটু বিরক্ত হলেন।। সরকারী হাসপাতালের বহির্বিভাগে রোগী দেখছেন তিনি।। বাইরে কমপক্ষে আরো শ’দুয়েক রোগী লাইনে দাঁড়ানো।। এর মধ্যে এ কোন আপদ!!! . সামনে পিঠ কুজো করে বসে থাকা নোংরা, মলিন শার্ট পরিহিত প্রায় অশীতিপর বৃদ্ধ তার গালের ঝুলে পড়া চামড়ায় একটু হাত বুলিয়ে ইতস্তত হয়ে হাসলেন।। . নাকের উপর মোটা কাঁচের চশমাটা ঠিক করলেন।। ভাঙা কন্ঠস্বরে বললেন- -বউয়ের নাম স্মরন করতি পারছুইন্না বাবা।। বিয়ে হয়েছে আজকা ষাইট বৎসরের মত।। হ্যায় ছিল এতিম, হের বয়স ছিল নয়, আমার সতের।। আমি তহন থেইকা ডাকি বউ, আর বাকীরা সবাই ডাকত হোসনার বউ।। আমার ছাওয়ালরা ডাকত আম্মা, হেগো নাতিরা ডাকে দাদী।। হ্যার নাম হের নিজেরো স্মরনে নাই।। হি হি।। . আমুদে রোমান্টিক বুড়ো দেখি! ডাক্তার সানজিদা একটা ঢোক গিললেন।। কী মুশকিল, প্রেসক্রিপশনে রোগীর নামতো আর হোসনার বউ, অমুকের আম্মা, তমুকের দাদী লেখা যায়না।। তাই ভাঙাচোরা হস্তাক্ষরে গটগট করে লিখলেন, রোগীর নাম, মিসেস হোসনা।। . -বয়স কত দিব চাচা? -হের বয়স আর কত অইব।। আমারতো এহনো আঠার বছর মনে অয়।। হে অহনো সাজলে মনে অয় লায়িকা শাবনূর।। . হেসেই ফেললেন ডাক্তার সানজিদা।। ঘোলাটে চশমার আড়াল হতে বৃদ্ধ যেভাবে প্রেমময় দৃষ্টিতে স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে কথাটি বললেন, তিনি আর না হেসে পারলেন না।। . বৃদ্ধা স্বামীর চোখে চোখ রেখে কি যেনো ইশারা করছেন।। মৃদু শাসন বোধহয়।। মুখে হাসি, সামনের সারির একটা দাঁত বোধ হয় কোথাও ঘুরতে গেছে।। পান খেয়ে লাল টুকটুকে ঠোঁট।। . -কী সমস্যা আপনার চাচী? বৃদ্ধা উত্তর দেওয়ার আগেই বৃদ্ধের ত্বরিত গতিতে জবাব, – রাইতে নাক ডাকে।। আমি ঘুম যাতি পারিনা।। . এবার বৃদ্ধার বাঁজখাই গলা শোনা গেল- -মিছা কথা বলবেন না আব্বাসের বাপ।। আমি নাক ডাকিনা।। আপনে কানে বেশি শোনেন।। কতবার বললাম আপনেরে কানের ডাক্তার দেখান।। . বৃদ্ধ মিনমিন করে বললেন, -আল্লার কিরা।। -কিরা কাটি মিছা কথা বলবেন না।। আমি নাক ডাকিনা।। নাক ডাকলে আমার ক্যান ঘুম ভাঙে না?? . প্রমাদ গুনছেন ডাক্তার সানজিদা বৃদ্ধ দম্পতির ঝগড়া দেখে।৷ বাইরে রোগীর শোরগোল বাড়ছে।। এরই মাঝে আবার মুঠোফোনে একটা বার্তা এসেছে।। মুঠোফোন হাতে নিয়ে বার্তাটি পাঠ না করেই রেখে দিলেন তিনি।। . তারপর প্রেসক্রিপশনে রেফারড টু ইএনটি লেখার আগে শেষবারের মত প্রশ্ন করলেন তিনি- -আর কোন সমস্যা আছে চাচী? বৃদ্ধা এবার বৃদ্ধকে ইশারা করে বললেন- -আপনে এট্টু বাইরে যান।। আমি আপার লগে এট্টু কথা বলব।। -আমার সামনে বলো।। -যান না বাহিরে।। . বৃদ্ধ চাচা মুখ বেজার করে বের হয়ে গেলেন।। ডাক্তার মনযোগ দিয়ে বৃদ্ধা চাচীর বাদ বাকী সমস্যা শুনলেন।। শোনা শেষে বললেন, -আপনারতো গাইনির ডাক্তার দেখাতে হবে।। চাচাকে নিয়ে দুইশ দশ নাম্বার রুমে চলে যান।। বৃদ্ধা খুশিমনে প্রেসক্রিপশন হাতে বেরিয়ে গেলেন।। . বৃদ্ধ দম্পত্তি বের হয়ে যাবার পরে একটানা ৬০/৭০ জন রোগীর প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে ঘড়ির কাঁটা প্রায় একটা ছুঁই ছুঁই। খিদেটাও একেবারে চাগিয়ে উঠেছে যেনো।। . রোগী দেখায় ইস্তফা দিয়ে ক্যান্টিনের দিকে রওয়ানা দিলেন হালকা কিছু খেয়ে নিতে।। . হাসপাতালের সামনে একটা গোল চত্বর।। এপ্রনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে ডাক্তার সানজিদা হাঁটতে হাঁটতে চত্বরের কাছাকাছি এসে দেখেন সেই বৃদ্ধা মহিলা বসে আছেন।। হাপুস নয়নে কাঁদছেন।। . কৌতূহলবশত কাছে গিয়ে ডাক্তার সানজিদা জিজ্ঞাসা করলেন- -কী হয়েছে চাচী? -আপনের চাচাকে খুঁজি পাতিসি না।। -সে কী! সাথে আর কেউ আসেনি? – ছাওয়ালরা তো আমরার লগে থাকেনা।। খোঁজও নেয় না।। -মোবাইল আছে সাথে? -আমরার আবার মোবাইল! -তাহলে তো সমস্যা।। বসে থাকেন, চাচা হয়ত আশেপাশে বাথরুমে গেছে।। চলে আসবে।। এই সান্ত্বনাসূচক বাক্যেও বৃদ্ধার কান্না থামল না।। -‘ও আববাসের বাপ,আপনে কই’- বলতে বলতে বোরখার খুটে বারবার চোখ মুছতে লাগলেন।। . বৃদ্ধার বিলাপকে পেছনে রেখে ভীষণ এক অস্বস্তি নিয়ে পা বাড়ালেন ডাক্তার সানজিদা।। . ক্যান্টিনে ঢুকেই একটা সমুচা, আর এক কাপ চা।। চিনিটা এত বেশি হয়ে গেছে যে, নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও চা শেষ করতে সময় লেগে গেলো।। . ক্যান্টিন হতে বের হয়ে গুটি গুটি পায়ে হেঁটে ফের হাসপাতালে ঢোকার আগেই দেখেন সেই গোল চত্বরে বৃদ্ধার পাশে এখন বৃদ্ধ বসে আছেন, এক হাতে দুটো সবুজ রংয়ের সস্তা আইসক্রিম।। . আরেকটু সামনে এগিয়ে দেখেন বৃদ্ধা তখনো কাঁদছেন, আর কলিমউদ্দীন সাহেব অন্য হাতে বউয়ের ভেজা গাল মুছে দিচ্ছেন।। . দ্বিপ্রহরের কড়া রোদ তখন মাথার উপর।। ঈশানকোণে এক টুকরো মেঘ জমেছে যদিও।। রোদের তীব্রতা তাতে কমেনি একটুও।। পশ্চিম দিকে থাকা আকাশমনি গাছটা হতে একটা বেনে বউ পাখি ডাকল কি ডাকল না, ডাক্তার সানজিদা মুগ্ধ চোখে বৃদ্ধ দম্পতিকে দেখতে থাকেন।। কাছে গিয়ে বললেন- -কী চাচা কই হারায়ে গিয়েছিলেন? -একটু পলায়ে ছিলাম।। দেখতাছিলাম আমারে না পালি আপনার চাচী কী করে।। কেমন কানতাসিল।। হি হি।। বৃদ্ধা চাচী অভিমানের স্বরে বলে উঠলেন- -কথা বলবেন না আমার লগে।। . বৃদ্ধ চাচা খুবই মিনতিপূর্ণ ভাবে বলতে লাগলো – -আইসকিরিম খাও বউ।। ও বউ।। ডাক্তার সানজিদা মৃদু হাসলেন।। কে বলবে, এনারা নব বিবাহিত দম্পতি নয়।। ছেলেমানুষের মত ঝগড়া করছেন, মান অভিমানও করছেন।। . বৃদ্ধ চাচা এবার চাচীকে আক্রমণ করলেন- -তুমি আমারে তহন বাহির করে দিলা ক্যান? -শরমের কথা আপনের সামনে- বলা যায়? আস্তাকফিরুল্লাহ।। -আচ্ছা আইসকিরিম খাও।। . জীবন সায়াহ্নে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে থাকা দুজন মানুষ, একটা জীবন এক সাথে হাতে হাত রেখে কাটিয়ে দেওয়া দুজন মানুষ, সবুজ রংয়ের সস্তা আইসক্রিম খেতে খেতে ফোঁকলা মুখে হাসছেন।।বার্ধক্যে জরাজীর্ণ একের হাতের উপর অন্যের হাত রাখা, দুর্বল হাতে সেই হাতখানা শক্ত করে ধরে রাখা।। মৃত্যু ছাড়া সে বাঁধন ছিন্ন করবে সাধ্যি আছে কার?? . দৃশ্যটা পিছনে ফেলে, প্রশান্তির এক মুচকি হাসি দিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে চললেন ডাক্তার সানজিদা,,,,,।। পিছনে তখনো চলছিলো বৃদ্ধ দম্পত্তির খুনসুটি,,,,,।।
লেখকঃ
সহকারী শিক্ষক, ইন্দুরকানী এম ইউ মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়।