মো.আলমগীর হোসেন
আজ রাতটা কি ভোর হবে? কান্না চোখে ভাবে বিউটি। মোবাইলের আলো জ্বালিয়ে সময় দেখার চেষ্টা করে সে।টপটপ করে চোখের জল মোবাইলের মনিটরে গড়িয়ে পড়ে।ঝাপসা চোখে দেখে সে,রাত সাড়ে তিনটা বাজে।আবারো চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করে,কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসেনা।সোনালি অতীত আজ নিকষ অন্ধকার হয়ে বারবার ফিরে আসে।তার সাদামাটা জীবনকে অতল কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে নিয়ে যায়।আস্তে, আস্তে মনে পড়ে হারানো প্রেমের স্মৃতি। সজীবের সাথে তার পরিচয়টা ছিল একেবারে আকস্মিক।একদিন ভোরে অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে তার ফোনে।কল রিসিভ করতেই অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসে এক মায়াবি কণ্ঠস্বর।সেদিনের সেই অপরিচিত মানুষটি বলেছিল- আপা এখনো ঘুমান কেন? জেগে উঠুন।দেখুন পৃথিবী কত সুন্দর,প্রকৃতি কত নির্মল। ভোরের ফুল, পাখি আপনাকে অভিবাদন জানাচ্ছে।বিউটি সেদিন চোখ কচলাতে, কচলাতে বিছানা ছেড়ে বাইরে এসেছিল। এই বসুন্ধরার বর্ণিল রুপ দেখে সে মুগ্ধ হয়েছিল।আস্তে, আস্তে অপরিচিত মানুষটির প্রতি তার কৌতুহল বেড়ে যায়।সেইসাথে বাড়তে থাকে সেলফোনে আলাপন। তারপর একটু, একটু করে ওরা একে, অপরের অনেক কাছে আসে।হয়ে যায় দুজনে,দুজনের খুব ভাল বন্ধু।কোন, কোন নারী -পুরুষ যে চিরকাল বন্ধু থাকতে পারেনা, বরং তারথেকেও উর্ধে চলে যায়, একথা তারা আবার প্রমাণ করে।নিজেদের অজান্তে মন দিয়ে দেয় দুজন, দুজনাকে।ওদের জীবনের ধারা পাল্টে যায়।দৈনন্দিন রুটিনে আসে পরিবর্তন। মাঝে, মাঝে বিউটি বলত-দেখো সজীব, আমার চেহারা কিন্তু ভাল না।পরে পস্তাবে তুমি।উত্তরে সজীব বলত-দেখো বিউটি এই নশ্বর পৃথিবীতে সবকিছুই একদিন বিবর্ণ হয়ে যায়।সুন্দর চেহারা দিয়ে কী হয়? আসল হলো সুন্দর একটা মন।তখন গর্বে বিউটির বুক ভরে উঠত।এমন সোনার মানুষ জীবনে সে দ্বিতীয়টি দেখেনি।রাত হলে ওরা হয়ে যেত রাতজাগা পাখি।সেদিন দিনের আলো ওদের কাছে ছিল বড় একঘেয়েমি আর অপ্রয়োজনীয়। প্রায় ওরা বলত চিরকাল রাত থাকলে কতই না মজা হত।তবুও থেমে থাকেনি ওদের কুটুর,কুটুর কথা।সেদিন উচ্ছল দুটি প্রাণ গাঙচিল হয়ে প্রেমের নদীতে ভেসেছিল।তারা কেবলই হয়েছিল দুজন দুজনার।ওদের যন্ত্রনায় সেলফোন দুটি বড় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল।যদি সেলফোন দুটির মামলা করার ক্ষমতা থাকত, তবে সেই মামলায় ওদের নির্ঘাত আজীবন জেল হয়ে যেত।তবে যান্ত্রিক সেলফোন দুটি সবসময় নির্যাতিত ছিলনা।মাঝে, মাঝে আদরে, আদরে হয়ে যেত একাকার।রাত গভীর হলে চলত সজীব বিউটির মধুর আলাপন। পিনপতন নীরবতায় শুরু হত ধারাবাহিক চুম্বন।তখন নিষ্প্রাণ সেলফোন দুটি যেন প্রাণ ফিরে পেত।লজ্জায় লাল হয়ে যেত।এভাবেই চলতে থাকল ডিজিটাল প্রেমের উপাখ্যান। অবশেষে একদিন ওরা দেখা করার,মুখোমুখি হবার তাগিদ অনুভব করে। দেখা হবে আগামী বুধবার,স্থান :রাধানগর ব্রীজ।এখানে বলে রাখা ভাল রাধানগর ব্রীজ ছিল বিউটির বাড়ি থেকে সামান্য দূরে,আর সজীবের বাড়ি ছিল পার্শ্ববর্তী একটি জেলায়।যাই হোক, দুজন এক নদী স্বপ্নে ভাসতে, ভাসতে দুজনের মুখোমুখি হল।বিউটি খুবই খুশি হলো।এমন আনন্দের অনুভূতি তার জীবনে আর কখনো আসেনি।সজীব ছিল তার প্রত্যাশার চেয়ে অনেক সুন্দর। এমন সুদর্শন, সুপুরুষ খুব কমই দেখা যায়।বিউটি সজীবের প্রতিক্রিয়া ক্লিয়ার বুঝতে পারল না।তাকে কেমন অপ্রতিভ দেখাচ্ছে! অল্প কিছুক্ষণ পর সে চলে যেতে চাইল।বিউটি খুব কষ্ট পেল কিন্তু মুখে সে কিছুই বলতে পারল না।নারীর কান্নার নদী চিরকাল বহমান এবং প্রছন্ন।নেই তার প্রতিবাদের ভাষা।সে শুধু ভাবল যে মানুষটা ফোনে এত কথা বলত সে এত নীরব, নিথর কেন! অত:পর কোন রকম সৌজন্য করে সজীবের প্রস্থান ঘটল।এভাবেই শেষ হয়ে যায় বিউটির প্রেমের গল্প।হায়রে জীবন! একজনের যা প্রেম অন্যজনের কাছে তা কেবলই ছলনা। তারপর সজীবের সিমটা চিরতরে বন্ধ হয়ে যায়।সেই নাম্বারে ফোন দিলেই এক মহিলা স্বয়ংক্রিয় কণ্ঠে বলে ওঠেন -আপনার কাঙ্খিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছেনা। একটু পরে আবার ট্রাই করুন।সেই একটু পর আর কখনো শেষ হয়না।কোন জনমে শেষ হবে বলে মনে হয়না।বিউটি আয়নায় মুখ দ্যাখে, সত্যিই সে কুৎসিত চেহারার।তাইতো সুন্দর মানুষটি তাকে ফাঁকি দিয়েছে।তার একটা সুন্দর মন ছাড়া আর কিছুই নেই।কী হবে এই সুন্দর মন দিয়ে? বিধাতার প্রতি তার প্রচণ্ড অভিমান হয়।সে কিছুতেই ভেবে পায়না সুন্দর মুখোশ পরে অসুন্দর মানুষগুলো কী করে এত সুখে আছে।একটি হৃদয় বিদারক ঘটনা বিউটির জীবন দর্শন পাল্টে দিয়েছে।এখন সে জানে- কল্পনা ক্ষণকালের জন্য অসুন্দরকে সুন্দর করে তোলে, কিন্ত বাস্তবতা চিরকালের জন্য অসুন্দরকে আরও অসুন্দরে পরিনত করে।কল্পনাশ্রয়ী হয়ে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া অনুচিত।